ঢাকা,মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির আটক বাণিজ্য রমরমা!

ঘুষ দিলে ‘সাতখুন’ মাফ!

নিজস্ব প্রতিবেদক ::
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির গাড়ি আটক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মাসিক টুকেন বাণিজ্য, চাঁদার জন্য যানবাহন আটক, টাকা পেলে ছাড় ইত্যাদি দীর্ঘদিনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। হিসাব না মিললে জুড়ে দেয়া হয় মামলা। হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক থাকলে ‘সাতখুন’ মাফ-এমনটি জানালেন ভুক্তভোগিরা।

ভুক্তভোগি চালক-হেলপাররা জানিয়েছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া পর্যন্ত মহাসড়কে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার বদৌলতে চলছে জোরজুলুম। হয়রানির শিকার হচ্ছে যানবাহন সংশ্লিষ্টরা। দিনে আটক করে রাতে ছাড়; রাতে আটক অবার দিনে ছাড়, এভাবে চলছে।
মূলতঃ কয়েকজন অসাধু কর্তার অনৈতিক কাজের কারণে বদনাম হচ্ছে মহাসড়ক পুলিশের। সেইসাথে মাত্র কয়েকজনের অবৈধ আয়ের কারণে যানবাহন খাত থেকে প্রতিমাসে সরকার হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব।

মোঃ নিজাম উদ্দিন নামের স্থানীয় একজন সংবাদকর্মী কিছুদিন আগে নিজের ফেসবুকে লিখেন, তিনচাকার যান আটক করে ৭-১২ হাজার টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে ছেড়ে দিচ্ছে। দিনরাত চক্রাকারে এ ঘটনা চলতে থাকলে ফাঁড়ি পুলিশের নেওয়া টাকাগুলো সরকার পাচ্ছে কিনা! রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এমন একটি পোস্ট তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে প্রকাশ করলে ফাঁড়ির ইনচার্জ তার উপর ক্ষেপে যান। পরে থানা পুলিশের মাধ্যমে ওই সংবাদকর্মীকে নানাভাবে ফাঁসাতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যদিওবা এমনটি অস্বীকার করেছেন ওসি।

অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। তাদের মাধ্যমে মহাসড়ক থেকে বৈধ-অবৈধ গাড়ি আটক করা হয়। একেকটি গাড়ি থেকে ৮-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে রাতের আঁধারে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বৈধ-অবৈধ বাছবিচার করা হয় না। কোন চালক টাকা দিতে না পারলে গাড়িগুলো ২ মাস পর্যন্ত ‘কাস্টোডি’র নামে জব্ধ করে থানায় রেখে দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবু বক্কর নামে এক দালালের মাধ্যমে তিন চাকার প্রতিটি গাড়ি থেকে মাসিক ১৫০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। যে সব চালকেরা টাকা দিবে না তাদের গাড়ি আটকে রেখে মামলার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা হয়।

জাহাঙ্গীর আলম নামের এক সিএনজি চালক অভিযোগ করেন, অনেক দুঃখ কষ্ট করে তিনি একটি সিএনজি কিনেন। এই সিএনজির টাকায় তার সংসার চলে। শবে বরাতের ফাতেহার দুইদিন আগে তার গাড়ি আটক করে হাইওয়ে পুলিশ। দুই পরে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। টাকাগুলো জোগাড় করতে তার অনেক কষ্ট হয়েছে। সিএনজি চালক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি সদরের ঈদগাঁও খোদাইবাড়ি এলাকায়।

একই অভিযোগ আবদুল্লাহ নামক সিএনজি চালকের। তিনি জানান, গত রোজার শুরুতে তার সিএনজি দৌঁড়াইয়ে ধরে ৩ হাজার টাকা আদায় করে। ৬ মাস মতো পরে আবার ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। হাইওয়ে পুলিশের ভয়ে আর সেই দিকে গাড়ি চালাতে যান না তিনি। সিএনজি চালক আবদুল্লাহর বাড়ি চকরিয়ার সাহারবিল। কিছু দিন আগে ৮ হাজার টাকা দিয়ে ছাড় পান ডুলাহাজারা রংমহলের অটো রিকশা চালক সাজ্জাদ।
তাদের অভিযোগ, তিন চাকার গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি করে আসছে আবু বক্কর নামের এক দালাল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাইওয়ে পুলিশের সাথে সম্পর্ক আছে এমন এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিন চাকার গাড়ি থেকে মাসিক আয় অন্তত ১০ লক্ষ টাকা। কয়েকজনে মিলে টাকাগুলো ভাগবাটোয়ারা করে। নির্ধারিত টুকেনের বাইরে সড়কে গাড়ি পেলেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সব দেখভাল করেন ক্যাশিয়ার হান্না ও মুন্সি হান্নান। তাদের হাত ধরে অবাধ বিচরণ দালাল সিন্ডিকেটের। এভাবে বছর খানেক ধরে এ হাইওয়ে ফাঁড়িতে চলছে দালাল পুলিশের রামরমা কার্যক্রম।

দালাল, ঘুষ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও আটক বানিজ্য অতীতের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশের ভয়ে এসবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতেও জনসম্মুখে মহাসড়কে চলছে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে মালবাহী ও অন্যান্য গাড়ি থেকে চাঁদা উত্তোলন করছে। চকরিয়া উপজেলার মেধাকচ্ছপিয়ার ঢালা, ডুলাহাজারা স্টেশন, বনানী, সাফারি পার্ক গেইট, তার দুশ মিটার উত্তরে ব্রিজের উপর, পুলিশ ফাঁড়ি গেইট, মালুমঘাট বাজারের উত্তরে রিংভং এলাকা এবং তারও উত্তরে মইক্ষা ঘোনা নামক পয়েন্টে বেশি হয়রানী।

চালক-মালিকদের অভিযোগ- জয়নাল আবেদীন, সোনামিয়া প্রকাশ গাছসোনা, শাহাব উদ্দিন ও শাহাজাহানসহ আরো কয়েকজন মহাসড়কের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সরাসরি টাকা পয়সার লেনদেন করেন না ফাঁড়ির ইনচার্জ। সম্পর্ক রয়েছে দালাল সিন্ডিকেটের। তাদের কললিস্ট চেক করলে অনায়াসে সত্যতা মিলবে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগিরা।

সচেতন মহলের প্রশ্ন- টমটম, অটোরিক্সা, সিএনজি থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা আয় হয় তা সরকারী কোষাগারে যায় কিনা?
এ প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির মুন্সি মো. হান্নানের সাথে শনিবার (১৩ জুন) বেলা দেড়টার দিকে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি জানান, বিগত প্রায় ২ মাস ধরে কোন গাড়ি আটক করলে ছাড়া হয় না। তা উপরের নির্দেশ। অফিসিয়াল প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হয়। দালাল সিন্ডিকেট বা গাড়ি আটকিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়। এসবের সঙ্গে নিজের কোন সম্পৃক্ততা নেই দাবী মুন্সি হান্নানের।

এরপর অভিযোগসমূহ সত্য কিনা জানতে ফাঁড়ির পরিদর্শক মোর্শেদুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন, সরকার ও আদালতের আদেশ মতে তার এলাকায় কোন সিএনজি, অটোরিকশা ইত্যাদি চলতে দেয়া হয় না। যে কারণে কিছু লোক ক্ষুব্ধ হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গাড়ি আটক বা ছাড় নিয়ে টাকা পয়সার লেনদেন সংক্রান্তে তার কোন সম্পর্ক নাই। অভিযোগগুলো সত্য কিনা জানতে সরেজমিন প্রতিবেদককে আমন্ত্রণ জানান ওসি মোর্শেদুল আলম চৌধুরী।

পাঠকের মতামত: